ঢাকা ওয়াসা দীর্ঘদিন ধরে সেবার মান উন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও অনিয়মের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সাবেক এমডি তাকসিম এ খান এর সময় হতে শুরু হওয়া এই দুর্নীতির ধারাবাহিকতা আজও চলমান যা প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও সেবার মানকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান ছিলো দুর্নীতির রোল মডেল । ফেসিস্ট হাসিনার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা ওয়াসাকে দুর্নীতির স্বর্গ রাজ্যে পরিণত করেছিলো । জুলাই- আগষ্টের বিপ্লবে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা প্রশাসনে রদবদল করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকা ওয়াসা এম ডি হিসেবে নিয়োগ পায় মোঃ ফজলুর রহমান এবং সচিব হিসেবে নিয়োগ পান মোঃ মশিউর রহমান খান । প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা করা হয় মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কে। সাধারণ শ্রমিক ও কর্মচারীদের ধারণা ছিল তাদের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসা কে গতিশীল ও দুর্নীতি মুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কতিপয় আওয়ামী সুবিধা ভুগী দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের মাধ্যমে নির্বাচন বিহীন শ্রমিক ইউনিয়ন কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সভাপতির পদ দখল করেন তৎকালীন ফ্যাসিষ্ট সরকারের সহযোগী আজিজুল আলম খান এবং সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করেন মনির হোসেন পাটুয়ারী। তাদের পদ দখলের মাধ্যমে ইউনিয়ন অফিস হয়ে ওঠে দুর্নীতির আঁতুড় ঘর। শুরু হয় কর্মকর্তাদেরকে মারধর এবং লাঞ্ছিত করার মহোৎসব। সাবেক এমডি একে এম শহীদ উদ্দিন এবং ডি এম ডি আকরুজ্জামান কে লাঞ্ছিত করে ওয়াসা ভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। ঢাকা ওয়সা সি বি এ ২৫২২ এর নির্বাচিত সভাপতি আনিসুজ্জামান খান শাহিন কে ১০ তলা থেকে ফেলে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। এখানেই শেষ নয় বর্তমান ইউনিয়নের সভাপতি আজিজ ও মনির পাটোয়ারীর দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হন “ঢাকা প্রতিদিনের” অনুসন্ধানী সাংবাদিকগণ। তথ্য মতে, বদলি, পদায়ন, প্রমোশন এবং আউটসোর্সিং নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আজিজ মনির সিন্ডিকেট গং। শুরুর দিকে ওয়াসা প্রশাসন এসবে কোন পাত্তা না দিলেও আজিজ ও মনির পাটোয়ারীর ফাঁদে পা দিয়ে তাদের দুর্নীতির পথের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে বর্তমান প্রশাসন। তথ্য রয়েছে কর্মকর্তাদের পদায়ন ও প্রমোশনে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা। আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগে নেওয়া হচ্ছে ১০/১২ লক্ষ টাকা। এতে করে বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা তাদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের দ্বারা খুব সহজেই আজিজ ও মনিরের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে পদ- পদবী ভাগিয়ে নিচ্ছেন। পক্ষান্তরে প্রকৃত জাতীয়তাবাদীমনা শ্রমিক কর্মচারী, কর্মকর্তাগণ অর্থের যোগান না দিতে পেরে নিগৃহীত হচ্ছেন। এ বিষয়গুলি নিয়ে একাধিক সময় বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রচারিত হলেও বর্তমান প্রশাসন আর্থিক লাভের দিকে তাকিয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷ ঢাকা ওয়াসা একটি স্বায়ত্তশাসিত সেবামূলক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে জর্জরিত। বিশেষ করে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সেবার মান ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।সরকারের আউটসোর্সিং নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট পদের বিপরীতে আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগের সুযোগ থাকলেও ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন তা লঙ্ঘন করছে। রাজস্ব সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থায়ী জনবল নিয়োগ না করে আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। গত ১৯/১২/২৪ ইং তারিখে ঢাকা ওয়াসা বর্তমান সচিব মোঃ মশিউর রহমান খান স্বাক্ষরিত স্মারক নং ৪৪৪৩ এর মাধ্যমে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়। এসকল আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে তড়িঘড়ি করে অর্গানোগ্রাম সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান প্রশাসন । এর ধারাবাহিকতায় গত ১৮/১২/২৪ ইং তারিখে স্মারক নং ৪৪১০ অনুযায়ী অর্গানোগ্রাম সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। যার বেশিরভাগ সদস্যরা তাকসিম এ খানের আমলে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা। ঢাকা ওয়াসায় বর্তমান রাজস্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ১০ টি জোনে মোট গ্রাহক হিসাব সংখ্যা প্রায় ৩৮৭৪১৬ টি এর বিপরীতে রাজস্ব বিলিং ও আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ইতোমধ্যে চাহিদার অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, সভাপতি আজিজুল আলম খান রাজস্ব জোন ৬ এ কর্মরত রয়েছেন । তিনি তার পদের প্রভাব খাটিয়ে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে অযোগ্য এবং অনভিজ্ঞ কর্মচারীদের কে তার জোনে পদায়েন করেছেন। রাজস্ব জোন ৬ সিলেট ক্লাব হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক মনির পাটোয়ারী রাজস্ব অঞ্চল ২ এ কর্মরত থাকার সুবিধা নিয়ে নিজের জেলা কুমিল্লার আউটসোর্সিং অধিকাংশ কর্মচারীদের কে নিয়ে কুমিল্লা ক্লাব গড়ে তুলেছেন। এসকল কর্মকান্ডের ফলে রাজস্ব আদায় ও বিলিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু কর্মকর্তা বলেন ঢাকা ওয়াসায় বর্তমানে কোন বোর্ড গঠিত হয়নি, বোর্ড না থাকার সুযোগে আজিজ ও মনির পাটুয়ারী এবং এমডি ও সচিব মিলে গড়ে তুলেছেন দূর্নীতির এক বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের অল্প কয়েক দিনের কর্মকান্ডে বুঝা যাচ্ছে তারা দুর্নীতিতে তাকসিম-এ-খান কে ও ছাড়িয়ে যাবে। ঢাকা ওয়াসায় কাজ নাই মুজুরী নাই (কানা মনা), মাষ্টারোল ২৬৩ জন কর্মচারী দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় মামলার মাধ্যমে আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও তাদের আত্মীয়করনে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন।উল্লেখ্য গত ২৫/৮/২৪ ইং তারিখে ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি এ কেএম শহিদ উদ্দিন আউটসোর্সিং বাতিল করে স্থায়ী জনবল নিয়োগের একটি চিঠি মন্ত্রণালয়ে পেশ করেন। তথাপি গত ২/৩ মাসে প্রায় ২০০ শতাধিক আউটসোর্সিং কর্মচারী পদের অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া হয়। কাল্পনিক পদ তৈরি করে এসকল জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে (যেমন Billing assistant,field assistant, )। ঢাকা ওয়াসা প্রবিধানমালা অনুযায়ি এসকল পদের কোন অস্তিত্ব নেই। তথ্য মতে, বর্তমান প্রশাসন ও শ্রমিক ইউনিয়নের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও কর্মকর্তা মিলে জন প্রতি ৮/১০ লক্ষ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের মহা উৎসবে মেতে উঠেছে। ১০ টি জোনের কাঠামো অনুযায়ী স্থান সংকুলান না হওয়ায় কর্মচারীদের কে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করাতে জোন প্রধানদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। নাম সর্বস্ব ভুয়া কোম্পানির নামে টেন্ডার দিয়ে এই কার্যক্রমের বৈধতা দিচ্ছে বর্তমান প্রশাসন। এ সকল দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক এবং কর্মচারীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করছে । তাদের ভাষ্যমতে বিএনপি এবং উপদেষ্টাদের নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি করে যাচ্ছেন বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা যা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী ইতিমধ্যে এ সকল বিষয়গুলো তথ্য প্রমান সহকারে দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা, সেবার মান এবং জাতীয় স্বার্থকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই দুর্নীতির জাল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন। ইউনিয়ন নেতাদের স্বার্থন্বেষী কার্যক্রম বন্ধ করা, নিয়ম বহির্ভূত আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগ বন্ধ করা এবং স্থায়ী জনবল নিয়োগ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করা জরুরী। অন্যথায় ঢাকা ওয়াসা একটি মৃতপ্রায় পরিত্যক্ত অবকাঠামোতে পরিণত হবে। যেখানে ঢাকাবাসীর পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
মন্তব্য করুন