এস এম রানা, নিজস্ব প্রতিবেদক : বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) এক প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাজ না করেই বিল প্রদান এবং নিম্নমানের পাইপ ও গেট ভাল্ব কেনাকাটায় নয়ছয় করা হয়েছে। হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। গত দুই যুগে বিএমডিএ’র প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত অবস্থায় শহিদুর অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট এবং রাজশাহী মহানগরীতে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া রাজশাহী মহানগরীতে প্লট এবং দেশের বাড়ি কুষ্টিয়ায় কিনেছেন বিপুল পরিমাণ জমি। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিতে শহিদুরকে সহায়তা করেছেন বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক (ইডি) আব্দুর রশিদ। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
বিপুল অর্থ তছরুপের ঘটনায় প্রকৌশলী শহিদুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ পড়েছে। অভিযোগের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং কৃষিমন্ত্রী ও সচিবসহ আরও কয়েকটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে।
দুদকে করা অভিযোগ এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুই বছর আগে প্রকৌশলী শহিদুর রহমানকে বিএমডিএ’র ‘ভূগর্ভস্থ সেচ নালা বর্ধিতকরণের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পে কাজ না করেই ৪১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেছেন তিনি। এ ঘটনায় বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামসুল হুদাকে প্রধান করে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা গত ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী পরিচালকের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেন। এতে ২৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা তছরুপের প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ পরিমাণ টাকার কাজ না করেই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তদন্তে অর্থ লুটপাটের বিষয়টি প্রমাণ হলেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ইডি আব্দুর রশিদ প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামসুল হুদা বলেন, অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন অনেক আগেই জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমি কথা বলব না। আমরা অধস্তনরা নির্বাহী পরিচালকের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারি না।
প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমান সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্য একশ কোটি টাকার ইউপিভিসি পাইপ এবং গেট ভাল্ব কিনেছেন। প্রকল্প পরিচালকের নিম্নমানের পাইপ ও গেট ভাল্ব কেনার বিষয়টি ওই প্রকল্পের মনিটরিং কর্মকর্তা বিএমডিএ’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল লতিফের নজরে আসে। এরপর আব্দুল লতিফ প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাহী পরিচালকের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ পাইপ কেনার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইপ কেনায় অনিয়ম করেই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া রাইজার ভাল্ব কেনায়ও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। শিডিউলে ১৫ কেজি ওজনের ভাল্ব কেনার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। তবে সেটি কেনা হয়েছে ১২ কেজি ওজনের। এ বিষয়টিও মনিটরিং কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেননি নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ। বরং নির্বাহী পরিচালক এবং প্রকল্প পরিচালক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পটিতে গভীর নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে এমএস হাউজিং পাইপ এবং এসএস স্টেইনার ব্যবহারের বিষয়টি শিডিউলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমান নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদের পরামর্শে নিম্নমানের প্লাস্টিকের হাউজিং এবং স্টেইনার দিয়ে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন।বিধান রয়েছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) কর্তৃক অনুমোদিত কোনো প্রকল্পের মালামাল একনেকের অনুমোদন ছাড়া পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু নির্বাহী পরিচালক এবং প্রকল্প পরিচালক সে নির্দেশনা আমলে নেননি। তারা ন্যাশনাল পলিমার এবং আরএফএল’র কাছ থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের অনুপযোগী ইউপিভিসি প্লাস্টিক পাইপ কিনে নলকূপ স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
মনিটরিং কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন মালামাল কেনায় অনিয়ম এবং দুর্নীতির বড় ধরনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমি ইতোমধ্যে নির্বাহী পরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। প্রতিবেদনে অনিয়মের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমানের রাজশাহীতে দুটি তিন হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। রোববার সকালে সরেজমিন গেলে রাজশাহী মহানগরীর অভিজাত আবাসিক এলাকা উপশহরের ২৭১/২ নম্বর ১০তলা ভবনের তিনতলায় এ ও বি নম্বরের দুটি পাশাপাশি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভবনটির কেয়ারটেকার সঞ্জয়।
অন্যদিকে বিএমডিএ’র কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা বলছেন, ঢাকার উত্তরা এবং উত্তর বাড্ডাতেও শহিদুর রহমানের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া দেশের বাড়ি কুষ্টিয়াতেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। দুই যুগ বিএমডিএতে কর্মরত অবস্থায় শহিদুর রহমান বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।
তবে ঢাকা এবং রাজশাহীতে ফ্ল্যাট থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রকৌশলী শহিদুর রহমান। তিনি বলেন, রাজশাহীতে আমার স্ত্রী তার বাবার পাওয়া জমি-জায়গা বিক্রি করে ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। আর ঢাকায় আমরা বিএমডিএ’র কর্মকর্তারা কিছুটা জায়গা কিনেছি। এরপর সেখানে ভবন তৈরি করা হয়েছে। আমি দুটি ফ্ল্যাট ভাগে পেয়েছি। তবে আমার দেশের বাড়িতে কোনো জমি নেই।
তিনি বলেন, প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগটি ভিত্তিহীন। কাজ না করে বিল দেওয়ার অভিযোগটিও বানোয়াট। এছাড়া নিম্নমানের পাইপসহ অন্য মালামাল কেনায় অনিয়মের যে অভিযোগটি করা হচ্ছে তাও মিথ্যা। তদন্ত প্রতিবেদনে অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে- এমন প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমানকে দুর্নীতি এবং অনিয়মে সহায়তার অভিযোগ অস্বীকার করে নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, এ বিষয়ে শহিদুর রহমানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। তাকে শোকজ করা হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন আমার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে কি না তা মনে নেই। কোনো অনিয়ম হলে ছাড় দেওয়া হবে না।
ধারাবাহিক প্রতিবেদন চলবে……..
© All rights reserved © 2012- 2024
<a href=”https://www.allbanglanewspaperbd.com/“>All Bangla Newspaper</a>
মন্তব্য করুন