ফেনী একটি নাম ,একটি ঘটনা বহুল ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপথ। প্রচীন যুগে “সমতট হরিকেলা” মধ্য যুগে “আমিরাবাদ/ আমিরগাঁও, “নবাবী যুগে “খাইয়ারা খন্ডল”সর্বশেষ আজকের ঐতিহ্যবাহী “ফেনী”
মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশে বহুনগর, বহুজনপথ সৃষ্টির ধারাবাহিক ইতিহাসই আজকের সভ্য আধুনিক দুনিয়ার নগর,বন্দর ,বিলাশী অট্টালীকার সীমাহীন বিস্তার লাভ। তেমনি ফেনী নদীর তীর ঘেঁসা “খাইয়ারা “জনপথ ,কালের পরিক্রমায় ফেনী হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ভারতের দেওয়ানী প্রথা, “চিরস্থায়ী বন্দবস্ত “ জমিদারী “ও পাট্টা প্রচলন শুরু হলে ক্রমান্বয়ে ফেনী শহরের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ফেনী শহরের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ব্রিটিশ আমেরিকান এলাইড ফোর্স ( মিত্রবাহীনি) কর্তৃক নির্মিত (১৯৪০-৪২সাল)বিমান বন্দর আজো টিকে আছে শহরের উত্তরাংশের বারাহিপুর নামক স্থানে। এ বিমান বন্দর ব্যবহৃত হতো জাপানী রয়াল আর্মী ও নেতাজি সুভাশ চন্দ্র বসুর “আজাদ হিন্দ পৌজ” এর বিরুদ্ধে তাদের যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযান ঠেকাতে।এখনও যুদ্ধের স্মৃতিভরা এয়ার ডিফেন্স টেক্সিওয়ে, শতাধিক সুরক্ষিত হ্যাঙ্গার কম্প্লেস্ক এর সাথে সংযোগ সড়ক বিমান বন্দরের চারিদিকে রানওয়ে থেকে নির্দিষ্ট দুরে বিদ্যমান। প্রতিটি হ্যাঙ্গারে সুরক্ষিত ও প্রস্তুত থাকতো একাধীক যুদ্ধ বিমান।প্রতিটি in হ্যাঙ্গার সুউচ্চ কংক্রিটের মজবুত দেয়াল দ্বারা আবৃত থাকতো যা এখনও দৃশ্যমান।
এই ফেনীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক ইতিহাস। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও আজোও সময়ের স্বাক্ষী হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে ঐসব স্মৃতিগাঁথা উপাখ্যান গুলো।
যেমন মুঘল যুগে ফেনীর কৃতিসন্তান শমশের গাজী বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার নির্মম হত্যা কান্ডের পর পুতুল নবাব বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফর ও ইংরেজ বনিক “ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দ্বৈত শাসনের বিরুদ্ধে এ অন্চলের জনগনকে সংগবদ্ধ করে ত্রিপুরা, ফেনী, মিরেশ্বরাই এলাকাকে নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। জনগনের কল্যানে বহুবিধ কর্মসুচি গ্রহন করেন। তার প্রতিষ্টত রাজ্য “খাইয়ারা খন্ডল” মাত্র ১২ বছর টিকে ছিলো নবাব মীর কাশেমের নির্দেশে এই বীর সেনানীকে কামানের গোলায় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার মাঝখানে সেই সময়ে খননকৃত “কৈয়ারা দীঘি” কালের স্বাক্ষী হয়ে আজোও টিকে আছে।
দাগনভুঁয়া উপজেলায়, উত্তর জায়লস্কর , দক্ষিন জায়লস্কর মুঘল যুগে আরাকানী মগ ও পুর্তোগিজ , ওলোন্দাজ, ইংরেজ ,বর্গী এবং জল দস্সু দমনে মুঘল সৈন্যদের ব্যবহৃত (ঘাঁটি )জায়গা হিসাবে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে।
তেমনি মহিপালের চাঁড়ীপুর দীঘি , এর দক্ষিনে বিজয়শিং গ্রামে বিখ্যাত বিজয়সেন দীঘি, ছোটসর্দার দীঘি, , ফেনী শহরের কেন্দ্রস্থলে রাজাজির দীঘি, ফেনী শহরের উকিল পাড়াস্থ রাজবাড়ী প্রচীন ইতিহাসের অনুসঙ্গহয়ে আজো টিকে আছে।এছাড়া ফেনী জেলার প্রতিটি গ্রামে প্রতিটি ইউনিয়নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের নানা ঘটনাবহুল কাহিনী ও স্থাপনা ।
বাংলার স্বাধীন সুলতান শামছুদ্দিন মুবারক শাহ আরাকান রাজাকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখল করেন এবং রাজধানী সোনারগাঁও থেকে কুমিল্লা, ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা নির্মান করেন যা ফেনী ট্রাঙ্ক রোড হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীতে আবার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁন কর্তৃক আরাকান রাজাকে পরাজিত করে রাজধানী “মারুক ইউথা” দখল করতে যে বিশাল নৌবহর ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন তাতে ফেনী নদী ও ট্রাঙ্ক রোর্ড ব্যবহারের ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। মুঘল শাহজাদা শাহ সুজা ত্রিপুরা রাজার সহযোগীতায় আরাকান যাওয়ার পথে এই ফেনী হয়েই আরাকান গিয়ে আরাকানী রাজার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। কুমিল্লা , ফেনী হয়ে চিটাগাং পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ট্রাঙ্ক রোর্ডের উপর ঐ সময়ের এক ঐতিহাসিক ‘রেনট্রী গাছ’ আজও ফেনী শহরের উকিল পাড়াস্থ দাউদপুর ব্রীজের পাশে জীবন্ত কালের স্বাক্ষী , যার বয়স আনুমানিক ৪০০ বছরের উপর।
ফেনী জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট বড় অনেক নদী যা ফেনী জেলাকে করেছে সমৃদ্ধ ,উন্নত। ফেনী নদী, কালীদহ নদী, ছোট ফেনী নদী, মহুরী নদী, সিলোনিয়া নদী সহ অসংখ্য নদী/ খাল।
এই ফেনী জিলায় জন্ম নিয়েছেন অনেক বিখ্যাত রাজনীতিক, সাংবাদিক , শিক্ষাবীদ ,ব্যাংকার , চলচিত্রনির্মাতা, ক্রিড়াবীদ।
ব্রিটিশ যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চেনসেলর স্যার এফ রহমান, যুক্ত পাকিস্তান এর সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং ডেইলী ওভজারবার পত্রিকার মালিক প্রয়াত রাজনীতিক হামিদুল হক চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপার্সন তিনবারেরর প্রধান মন্ত্রী দেশ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ,মোহামেডান ক্লাবের সাবেক স্ট্রাইকার প্রয়াত গোলাম নবী চৌং ফেনীর সকলের কাছে সুপরিচিত জনমানুষের নেতা সাবেক সাংসদ প্রয়াত খাজা আহম্মেদ ,চলচিত্রনির্মাতা প্রয়াত জহির রায়হান ও সহিদুল্লাহ কায়সার, প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিষ্ট গিয়াস কামাল চৌং বেসরকারি ব্যাংক / বীমা প্রতিষ্ঠার অগ্র পথিক মুজিবুল হায়দার চৌং সহ অসংখ্য জ্ঞানী গুনী এই ফেনী জেলার কৃতী সন্তান।সময়ের সল্পতা ও লিখার সংক্ষেপতার কারনে অনেক কৃতী মানুষের নাম লিখতে পারিনি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ফেনী ছিলো উন্মুক্ত রনাঙ্গন।
বহু মুক্তিযাদ্ধার রক্তে রাঙ্গানো অলিগলির আঙ্গিনা, গ্রাম জনপথে যুদ্ধাহত বীর সেনানীদের চিহ্ন বিচ্ছিন্ন দেহাবেশেষের ইতিহাস ,”ফেনী “ নিদারুন কষ্টে বুকে ধারন করে আছে স্বজন হারানোর বিয়োগ বেদনার করুন কাহিনীগুলো। আজও খুঁজে ফিরেন সন্তান হারা মা, পিতৃহারা মেয়ে , ভাই হারানো বোন তাদের প্রিয় স্বজনদের।ফেনী জেলায় বহু খেতাবপ্রাপ্ত রনাঙ্গনের মুক্তিযাদ্ধা এখনও জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে বেঁচে আছেন । যথাযত সম্মান , উপযুক্ত মূল্যায়ন, আমরা তাদের এখনও দিতে পারিনি।দেশমাতৃকার টানে যারা জীবনের সমস্ত লোভ, স্ত্রী সন্তানের/ বাবা মায়ের পবিত্র ভালোবাসা / আদর সোহাগ ত্যাগ করে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধের ভয়াল প্রান্তরে , আমরা কি তাঁদের সীমাহীন ত্যাগের কথা মনে করি? মর্যাদা ভরে তাদের স্মরন করি?
এতো সমৃদ্ধ জনপথ , এতো ঘটনা বহুল ঐতিহাসিক
“ফেনী জেলায় “বহু প্রতিতযশা জ্ঞানী গুনীর আদী জন্মস্থান হলেও ফেনী জেলাতে নেই কোন বিশ্ববিদ্যালয় , মেডিক্যাল কলেজ কিংবা প্রকৌশল /কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়।
নিয়তির এক চরম সত্য,” ফেনী জেলা” বৈচিত্রময় এক অর্নৈতিক সম্পদশালী উন্নত জেলা।
——//-//
আবদুল লতিফ জনি।
মন্তব্য করুন