নিজস্ব প্রতিবেদক:
আজ ৫ আগস্ট—বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক জাগরণের এক অবিস্মরণীয় দিন। এক বছর আগের এই দিনে ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে পতন ঘটে দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের। ‘বাংলাদেশ টু পয়েন্ট ও’ নামে পরিচিত এই জনতার অভ্যুত্থান গড়ে তোলে একটি বৈষম্যহীন নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন।
গত বছরের ১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয় আন্দোলনের ঢেউ, যা ৩ আগস্টে রূপ নেয় এক দফা সরকার পতনের দাবিতে। ৪ আগস্টের ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি প্রাণঘাতী সহিংসতায় রূপ নেয়, যেখানে বহু প্রাণ ঝরে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীরা ৫ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে, যা স্বৈরাচার পতনের দিন হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে ওঠে।
🔥 লাখো মানুষের ঢল, গণভবন দখল
৫ আগস্ট সকাল থেকেই রাজধানীজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। দুপুর ১১টার পর লাখো মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে নামে। শহীদ মিনার, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর—প্রতিটি প্রান্ত থেকে রাজধানীমুখী মানুষের ঢল নামে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও আইএসপিআরের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট হয়, সরকার হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। দুপুর আড়াইটার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সামরিক বিমানে করে দেশত্যাগ করেন। দেশ ছাড়ার আগে গণভবন থেকে বিমানঘাঁটি হয়ে তাঁরা ভারতের গাজিয়াবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
🏛️ সেনাপ্রধানের ভাষণে জাতির নিশ্চিত হওয়া
দুপুর সোয়া ১টায় আইএসপিআর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের ঘোষণা দেয়। দুপুর ৩টায় দেওয়া সেই ভাষণে নিশ্চিত করা হয়—দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বৈরাচার পতনের নিশ্চিত বার্তায় গোটা জাতি বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ে।
ছাত্র-জনতা গণভবনে প্রবেশ করে বিজয় মিছিল করে, কেউ আবেগে কাঁদে, কেউ নামাজ আদায় করে কৃতজ্ঞতা জানায়। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ রাষ্ট্রীয় প্রতীকগুলোতে ছিল জনগণের সরব উপস্থিতি।
☠️ সহিংসতার নির্মম দৃশ্য
এই উল্লাসের মাঝেও রাজপথে রক্ত ঝরছিল। যাত্রাবাড়ি থানার সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান অন্তত ৫৫ জন। আশুলিয়ায় পুড়িয়ে মারা হয় ৬ জনকে। বিভিন্ন থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের খবরও আসে।
যশোরে আওয়ামী লীগের নেতার হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ২৫ জন, যাদের অনেকেই বিদেশি নাগরিক। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় প্রাণ হারান ১০৯ জনের বেশি মানুষ, আহত হন বহু।
🤝 অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথে
বিকালে সেনানিবাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, “এই আন্দোলনে শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে না। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবো এবং সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করব।”
🕊️ নতুন প্রজন্মের বিজয়
এই প্রজন্ম হয়তো ১৯৭১ দেখেনি, কিন্তু তারা গড়েছে এক নতুন ইতিহাস। এক বৈষম্যহীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দিগন্ত উন্মোচন করেছে ৫ আগস্ট। আজকের এই দিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষার বাতিঘর হয়ে থাকবে।
মন্তব্য করুন