পর্ব-১
নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর মতিঝিল ভূমি অফিস এখন দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ভূমি সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামীলীগের দোসর সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোসাঃ নিরুন নাহার বেগম নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে সেবাকে রূপ দিয়েছেন এক প্রকার ঘুষ বাণিজ্যে।
সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ—দিনের পর দিন ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না। অথচ দালালদের হাত দিয়ে টাকা গেলে মুহূর্তেই ফাইল উধাও হয়ে আবার জাদুর মতো হাজির হয়।
নানা ধরণের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র
🔹 ১. দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য
অফিস ঘিরে সক্রিয় একটি দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের ফাইল আটকে রাখা হয়। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইঙ্গিতে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়। এই দালাল চক্র অফিসের ভেতর ও বাইরেই নির্দ্বিধায় ঘোরাফেরা করে।
🔹 ২. ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না
ভূমি নামজারি, খতিয়ান সংশোধন, দলিল ভেরিফিকেশনসহ সব কাজেই গোপনে ঘুষ লেনদেন চলে। অভিযোগ রয়েছে, সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সরাসরি টাকা না নিলেও দালালদের মাধ্যমে ঘুষ সংগ্রহ করেন। এক ভুক্তভোগীর ভাষায়—
“আমাদের খোলাখুলি বলা হয়, টাকা না দিলে ফাইল মাসের পর মাস আটকে থাকবে।”
🔹 ৩. হয়রানি ও ভোগান্তি
প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও সাধারণ মানুষ সেবা পান না। ফাইল খোঁজা, রেকর্ড বের করা, সিল-সাইন করানো—সবকিছুতেই টালবাহানা চলে। অথচ টাকার বিনিময়ে দালালের ফাইল সরাসরি কর্মকর্তার টেবিলে পৌঁছে যায়।
🔹 ৪. রেকর্ড রুমে গোপন বাণিজ্য
রেকর্ড রুমে প্রতিদিন গোপনে ঘুষ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ। কিছু ফাইল ‘হারিয়ে যাওয়া’ নাম দিয়ে জিম্মি করা হয়, পরে মোটা অঙ্কে ‘মিলিয়ে দেওয়া’ হয়।
🔹 ৫. নকল ও প্রতারণা
ভূমি অফিসে নকল দলিল, জাল খতিয়ান তৈরি ও ভুয়া সনদ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এসব কাজও দালাল চক্রের মাধ্যমে হয়, কর্মকর্তাদের নীরব সম্মতিতে।
🔹 ৬. অনলাইনে সেবার নামে নতুন চাঁদাবাজি
সরকারের ডিজিটাল ভূমি সেবার ব্যবস্থা থাকলেও অফিসে সেটিকে জটিল করা হয়েছে। অনলাইন ফাইল ‘প্রসেসিং ফি’ নাম করে অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হয়। সাধারণ মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল দেখিয়ে আবার নতুন করে টাকা খরচ করতে বাধ্য করা হয়।
🔹 ৭. প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়া
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও কিছু অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এই দালাল চক্র ফুলেফেঁপে উঠেছে। ফলে কেউ অভিযোগ করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
ভুক্তভোগীদের বয়ান
এক ভুক্তভোগী জানান:
“সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঘুরেছি। কোনো কর্মকর্তা কথা শুনলেন না। অথচ যাদের হাতে টাকা, তাদের কাজ মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল।”
আরেকজন বলেন:
“আমাদের সরাসরি বলা হয়—‘টাকা দেন, না হলে কাজ হবে না’। এভাবে বাধ্য হয়ে দালালের মাধ্যমে ঘুষ দিতে হয়।”
কর্মকর্তার নীরবতা
সরেজমিনে ভারপ্রাপ্ত সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মোসাঃ নিরুন নাহার বেগমকে অফিসে পাওয়া যায়নি, মুঠোফোনে একাধিকবার কলদিলে রিসিভ করেননি।
এ বিষয় মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের সহকারী ভুমি কমিশনার আবিদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি নতুন জয়েন্ট করেছি মাত্র, ইতিমধ্যে নিরুন নাহারসহ আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আসছে বলে জানান, তিনি তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত পুর্বক ব্যাবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
সুশীল সমাজ মনে করে, সরকারি দপ্তরে দালাল ও ঘুষ বাণিজ্য দেশের সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ভূমি আইনজীবীরা বলছেন, ভূমি অফিসের দুর্নীতি দীর্ঘদিনের সমস্যা। কঠোর জবাবদিহি ও নজরদারি ছাড়া এ থেকে মুক্তি নেই।
সাধারণ মানুষের দাবি
১. দালাল চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক।
২. অফিসে ঘুষ লেনদেন বন্ধে স্বচ্ছ ও ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করা হোক।
৩. সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি বন্ধে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু হোক।
৪. অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, মতিঝিল ভূমি অফিসে ঘুষ ও দুর্নীতির সমান্তরাল এক কালোবাজার গড়ে উঠেছে। সেবার নামে চলছে প্রতারণা, দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই অনিয়ম বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
মন্তব্য করুন