ধারাবাহিক প্রতিবেদন: ০১ (জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল)
মোহাম্মদ মারুফ হোসেন (বিশেষ প্রতিনিধি):
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা। রাজধানীর নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত একটি সরকারী হাসপাতাল। সাধারণ মানুষ হঠাৎ করে বুকে ব্যাথা অনুভব করলেই এই হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য। এই হাসপাতালে প্রবেশ করলেই প্রতি পদে পদে আপনাকে টাকা দিয়ে সেবা নিতে হবে। প্রথমেই আসেন টিকিট কেনা। সরকার নির্ধারিত ১০ টাকা টিকিটের মূল্য হলেও অনেকের কাছে ভাংতি না থাকার কারণে ২০/৪০ টাকা বেশি নেয়া হয়, যার কোন জবাবদিহিতা নেই। তারপর দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা। ডাক্তার ইসিজি করতে দেন। এখানে সরকার নির্ধারিত ৮০ টাকা হলেও উনারা তা রাখেননা। ক্ষেত্র বিশেষে সেটা ১০০/১২০ টাকা হয়ে যায়। তারপর ইসিজি রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা। এখানেও দীর্ঘ লাইন থাকে। ডাক্তারের কক্ষে দায়িত্ব পালন করা আয়া বা বয়কে ২০/৫০ টাকা ঘুষ দিলেই আগে সিরিয়াল পাওয়া যায়। ভিতরে ঢুকলেই দেখা যায় ডাক্তার সাহেবগণ মাত্র কয়েক ঘন্টা ডিউটি সেটাও উনারা ঠিক মত দিতে চাননা। কেউ কেউ মোবাইলে খোশগল্পে মত্ত থাকেন। এক সাথে ২/৩ জন করে রোগী দেখেন। যত দ্রত সম্ভব রোগীর সাথে ভালভাবে কথা না বলেই এই টেস্ট সেই টেস্ট দিয়ে দেন। রোগী তখন বের হয়ে ছুটে টেস্ট করানোর জন্য। এত বড় সরকারী একটা হাসপাতাল অথচ প্রায় এখানকার এক্সরে মেশিন, ইকো, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন বন্ধ/নষ্ট থাকে, রিপোর্টও দেরিতে দেবে বলে রোগী কিছু দালালের খপ্পরে পড়ে বাইরে থেকে টেস্ট করাতে যায়। সেখানে আশে পাশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা কিছুৃ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে বেশি টাকা খরচ করে টেস্ট করাতে দেয়। সেই রিপোর্ট নিয়ে পুনরায় ডাক্তার দেখানো। রোগীর সিরিয়াস কোন সমস্যা না থাকলে প্রাথমিক অবস্থায় মেডিসিন দিয়ে দেন, সিরিয়াস হলে ভর্তি হতে রেফার করেন। এইখানে চলে মহা ঘুষের খেলা। কোথাও সিট নেই। রোগীকে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বারান্দায় নোংরা একটা বেড নিয়ে চিকিৎসা নেয়ার জন্য অবস্থান নিতে হয়। ডাক্তার ঠিক মত আসেন না। কর্তব্যরত নার্স থেকে শুরু করে কাউকে ঠিক মত পাওয়া যায়না। আর স্টাফদের ব্যবহার এত খারাপ যে বলার মত না। রোগী বা রোগীর কোন আত্মীয় যদি কোন কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় তাকে নানারকম অপমানসূচক বাণী শুনতে হয়। বাহিরে অবহেলা ও অনাদরে রোগী পড়ে থাকে দিনের পর দিন। আশেপাশের রোগীর দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাস বা রোগজীবানু যে তার মধ্যেও প্রবেশ করে নাই সেটা কে বলতে পারে? রোগী এখানে ২/৩ দিন পর যখন অতিষ্ঠ হয়ে যায় বাধ্য হয়ে টাকা পয়সা দিয়ে একটা সিটের ব্যবস্থা করতে এর কাছে ওর কাছে ধন্যা দেয়। ৫০০-১০০০ টাকা ঘুষের বিনিময়ে বেড পাওয়া যায়। এখানে আয়া ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাতো জমিদারের মত আচরণ করেন। টাকা না দিলে তারা কোন কাজই করবেনা। এখানেও যে ক’দিন রোগীকে থাকতে হয় গুণতে হয় টাকা। রোগীকে কোন পরীক্ষা করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক বিড়ম্বনা। রোগীকে বসিয়ে হুইল চেয়ার সহজে পাওয়া যায়না। পেলেও সেটা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়, আবার রোগীকে আসা-নেয়ার ব্যাপারেও টাকা দিতে হবে। রোগীর প্রয়োজনীয় ওষুধ সহ অন্যান্য কোন কিছু কেনার জন্য আগেই ঠিক করে টাকার কথা বললে উনারা সেবা দেন। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে জরুরী ভিত্তিতে আইসিইউতে নেয়া হয় যদি পর্যাপ্ততা থাকে। না হলে অন্য কোন হাসপাতালে খোঁজ খবর নিয়ে সেখানে ভর্তি করাতে হয়। আল্লাহ না করেন যদি কোন রোগী মারাত্মক অবস্থায় মারা যান তাহলে তার আরো যে কত ভোগান্তি পোহাতে হয় তার ইয়ত্তা নেই! রোগীর মৃত্যু স্বাভাবিক না হলে তাকে ময়নাতদন্ত করাতে বাধ্য করা হয়। রোগীর মরদেহ পড়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। নানারকম ফরমালিটি শেষ করে লাশ নিয়ে বের হওয়ার সময় লাশ টেনে আনার জন্য বয়কে ৫০০-১০০০ টাকা দিতে হয়। লাশ বহনকারী এম্বুলেন্স এর সিন্ডিকেট পুরো হাসপাতাল জুড়ে। বাধ্য হয়ে দ্বিগুন, তিনগুণ টাকায় লাশ নিয়ে স্বজনরা বাড়ি ফিরে নিঃস্ব ও মনে এক রাশ দুঃখ বেদনা নিয়ে। এভাবেই চলছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম একটি হাসপাতাল এর চিকিৎসা সেবা। এ ব্যাপারে বহু রিপোর্ট করা হয়েছে, হয়েছে তদন্ত কমিটিও, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদের সিন্ডিকেট এত বড় যে বলার মত না। হাসপাতালের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই বাজে ও নোংরা। টয়লেটগুলো নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। খাবার পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
উপর থেকে নিচে চিকিৎসা সেবা দানে জড়িত সবাই কোন না কোন ভাবে এসব অনিয়ম ও দূর্নীতির সাথে জড়িত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আমরা চিকিৎসাক্ষেত্রের উন্নতি করতে পারলাম না। সামর্থবানরা হয়তো বেসরকারী বা বাহিরের কোন দেশে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হবেন কিন্তু আপামর জনগণের কি হবে? তাদের কি দেখার কেউ নেই?
মন্তব্য করুন